প্রথম বিয়েটে আমার টেকেনি।আমি নিজেই আর টিকিয়ে রাখতে চাই নি।তাই একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছিলাম।বাইরের লোকের কাছে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমার স্বভাব চরিত্র ভালো নয়।আমি নাকি চরিত্রহীন, তাই বাড়ি ছেড়ে চলে এলে গিয়েছি।
আমি মনে করি অপমানের থেকে আত্ম সম্মান অনেক বড়ো।যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম সেদিন একটু দরকারে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম।সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরতেই শাশুড়ি আমাকে বললেন,
--বাপের বাড়ি যাবার নাম করে কোথা থেকে ঢলাঢলি করে এলে?
--কী সব বাজে কথা বলছেন?
---ঠিকই বলেছি।অমূল্য নিজে চোখে দেখেছে কলেজ মোড়ের একটা গলি থেকে একটি ছেলের সাথে ফস্টিনস্টি করে তুমি বেরিয়ে আসছো।বাড়ির ফেরার তো দরকার ছিল না।ওর সাথেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারতে।
বলে রাখা ভালো এই অমূল্য আসলে আমার নন্দাই।আমার একমাত্র ননদের হ্যাজব্যাণ্ড।তো আমি বললাম,
---দেখেছে ঠিকই।আবির আমার ভালো বন্ধু।স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।ওর থেকে দুটো বই নেওয়ার জন্যই গিয়েছিলাম।একদম বাজে কথা বলবেন না।
--থাক।অনেক হয়েছে।বাহানা দেখিয়ে আর কাজ নেই।ও সব আমার জানা আছে।পর পুরুষের সাথে ফূর্তি মারিয়ে ঘরে আর ফিরলে কেন?বেশ্যা গিরি করতে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে করো।এসব আমার বাড়িতে থেকে চলবে না।দুশ্চরিত্র একটা মেয়ে।
---মুখ সামলে কথা বলবেন।অনেক দিন ধরে সহ্য করছি।আর করব না।
---তা সহ্য করছো কেন? আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে তো দিয়েছো।এবার বিদেয় হও দিকিনি।
শাশুড়ির এমন কথায় মুখ বুজে মেনে নিতে না পেরে জবাবটা দিয়েছিলাম সেদিন।এত খারাপ কথা কেউ বলতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল না।এই অপমান আর সহ্য করতে পারিনি।তারপর সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিই।ওই বাড়িতে থাকলে একদিন শেষ হয়েই যেতাম।
আমার স্বামী ছিল পুলিশ।কনস্টেবল পদে কর্মরত।বিয়েটা আমার দেখাশোনা করেই হয়েছিল।আমাদের এক আত্মীয় আমার বিয়ের সম্বন্ধ করে ছিলেন।উনি আমার বাবাকে বললেন,
--সরকারি চাকরি করা একটা ভালো ছেলে আছে।মেয়ের বিয়ে দেবে?
---মেয়ে তো এখন পড়াশোনা করছে।
ওই আত্মীয় হেসে বলেছিলেন,
---রাখো তো তোমার পড়াশোনা।বিয়ে তো দিতেই হবে।একটা সরকারি চাকরী করা ছেলে পাবে তো?তোমার সে রকম অবস্থাও ভালো নয়।একটা কানাকড়ি কিছুই নেবে না।
আমি তখন এম.এস.সি পড়ছি। কী জানি আমার বাবা তখন কী বুঝল জানি না।আমার বিয়ে দেবার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন।আমি রাজী ছিলাম না।পড়াশোনা কমপ্লিট হলো না তার মধ্যেই বিয়ে?বাবা মা সবাই মিলে বুঝিয়ে দিল সরকারি চাকরি করা ছেলে।এই বাজারে একটা সরকারি ছেলে পাওয়া মুশকিল।মধ্যবিত্ত ঘরের বাবা মায়েরা ভাবেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া মানেই একটা নিশ্চিন্ত জীবন যাপন।কিন্তু কতটা নিশ্চিন্ত জীবন যাপন সেটা উপলব্ধি করলাম বিয়ের পর।
সরকারি চাকরি করা ছেলে এটাই অনেক বড়ো ব্যাপার।তাই চাকরিটাই সব।তার শিক্ষাগত যোগ্যতা না দেখলেও চলে।একজন কোনো রকমে মাধ্যমিক পাশ করা ছেলের সাথে গণিতে এম.এস.সি পাশ একটি মেযের বিয়ে হয়ে গেল।মানে বিয়েটা দিয়ে দেওয়া হলো। আমার জীবনে সব থেকে বড়ো একটা খারাপ লাগার জায়গা এটাই
বিয়ের পর বুঝলাম যোগ্যতা বিচার হয় সরকারি চাকরি দ্বারা।আমি যেহেতু কোনো চাকরি করি না তাই আমি অযোগ্য।শিক্ষাগত যোগ্যতাটা কোনো যোগ্যতাই নয় তাদের কাছে।স্বামী মানুষটি যেহেতু সরকারি চাকরি করে তাই তার পদানত হয়েই থাকতে হবে। বিয়ের দু মাস পর একদিন বলেই ফেলল,
---এম.এস.সি করে কী করেছো?চাকরি পেয়েছো একটা?মাধ্যমিক পাশ হতে পারি কিন্তু সরকারি চাকরি করি।দম থাকলে চাকরি পেয়ে দেখাও।
নিজের ওপর ভীষণ রাগ হতে লাগলো।সত্যি তো এম.এস.সি পাশ করে এই রকম একটা ছেলেকে বিয়ে করলাম? অবশ্য বিয়ের আগে সবাই মেয়েদের পড়াশোনা জানতে চায়। ছেলেদের পড়াশোনাটা কে আর জানতে চায়? সরকারি চাকরি মানে সে মহাপুরুষ।তাই আর না জানলেও চলে।নিজেকে হেরে যেতে দেখতে লাগলাম।বিয়ের পর আমি যেন আর আমার মধ্যে নেই।না আছে আমার পড়াশোনার জগৎ না আছে স্বামীর সঙ্গ সুখ।উনি বিয়ে করে দায় সেরেছেন মাত্র।কারণ ওনার ছুটি নেই।মাসে এক দিন বা দুদিনের জন্য বাড়িতে আসেন রেস্ট নিতে। তাছাড়া বাড়িতে মা একা থাকেন। বাড়িতে একটা লোকের প্রয়োজন।তাই বিয়েটা করেছেন।এক দম বন্ধ করা জীবন আমার।স্বামীকে কিছু বলতে গেলেই বলতেন,
---জেনে শুনেই বিয়ে করেছো।তোমার বাহানা শোনার জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসিনি।আমাদের মতোই চলতে হবে।
তবুও মেনে নিয়ে চলছিলাম।এরপর যা ঘটলো সেটা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়লো।বাড়িতে একজন মানুষের যখন তখন আগমন হতে লাগলো।উনি আসলে আমার নন্দাই অর্থাৎ অমূল্য বাবু।শাশুড়ি মায়ের বড়ো আদরের জামাই। নানা অছিলায় আমার ঘরে এসে ঢুকে পড়তেন।স্বভাবটা হলো গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা।যেটা আমার পছন্দ না।একদিন এমন টাইমে এলেন শাশুড়ি মা কী একটা দরকারে বাইরে গেছেন সেই সময়ে হাজির।আমাকে একা পেয়েই শুরু করলেন টানা হ্যাঁচড়া।রাগে থাকতে না পেরে গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিলাম।শাশুড়িমাকে বলতে শাশুড়ি মা বললেন,
---তুমি অমূল্যর নামে এসব কথা মুখে আনলে কী করে?ও তোমাকে নিজের বোনের মত দেখে।ছি! তুমি নিজেই একটা চরিত্রহীন।ও আর এ বাড়িতে আসতে পারবে?নিজের মতো করে সবাইকে ভেবে নাও তাই না?
কথাটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম।সব দোষ হয় বাড়ির বৌয়ের।জামাই হয় ধোয়া তুলসী পাতা।শাশুড়ি আবার এই খবর ছেলের কানে পৌঁছে দিলেন।তারপর থেকে শুরু হলো খারাপ ব্যবহার।কথায় কথায় আমাকে শুনতে হতো আমি দুশ্চরিত্র।বাবা মায়ের ওপর ভীষণ রাগ হতে লাগলো।মেয়ের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবন খুঁজে দিতে বিয়ে দিয়ে দিলেন।বুঝলাম মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরের চার দেওয়ালটাও তাদের জন্য সুরক্ষিত নয়। সেখানেই থাকে হিংস্র দানবরা।একদিন বাড়িতে ভীষণ অশান্তি হয়।একদিকে আমি আর একদিকে বাড়ির সবাই।রাগে বাপের বাড়ি চলে যাই ক'দিনের জন্য।মাকে গিয়ে সব কথা বলি।মা বলে,
---ওরকম একটু আধটু হয়েই থাকে।মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়।এখানে বেশি দিন থাকলে লোকে খারাপ ভাববে। তাই তুই ফিরে যা।
বুঝলাম মেয়েদের বিয়ের পর বাপের বাড়িটা তাদের আর আস্তানা নয়।বাপের বাড়ি থেকে ফিরলাম। ওই সময়েই আমার স্কুল লাইফের বন্ধু আবিরের সাথে দেখা হয়।আবিরকে সব কথা বলি।আবির বলে,
---তুই চাকরির জন্য পড়াশোনা শুরু কর।আমি তোর পাশে আছি।
তারপর থেকে লুকিয়ে পড়াশোনা শুরু করি।এবং ঠিক করি বাপের বাড়ির সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। বইপত্র বা টুককাক কিছু দরকার পড়লেই বাপের বাড়ি যাবার নাম করে বেরিয়ে যেতাম।ইতিমধ্যে আমাকে আবিরের সাথে দেখে ফেলে অমূল্য।বাড়িতে এসে শাশুড়িমাকে সে সব কথা জানিয়ে দেয়।তারপর থেকে অশান্তি চরমে ওঠে আরো।অবশেষে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি।
তবে আমার জীবনে আবির দেবদূত হয়ে আসে।একজন ভালো বন্ধুর যে কতটা প্রয়োজন সেটা উপলব্ধি করে সেদিন রাতে।আবিরকে ফোন করে যখন বলি,
---আবির আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।কিছু একটা একটা ব্যবস্থা করে দে। তা না'হলে আমি শেষ হয়ে যাব।আমি নতুন করে বাঁচতে চাই।
আবির বলেছিল,
---সে না হয় ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।তোর বাপের বাড়িতে ফিরে যেতে পারিস তুই।
---যতদিন না নিজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি ততদিন আমি কোথাও যাব না।বাপের বাড়ির সাথে আমি কোনো যোগাযোগ রাখতে চাই না।
অবশেষে আবির ব্যবস্থা করে দেয় ওর পিসির বাড়িতে।পিসি বাড়িতেই একাই থাকে। পিসির একটি মাত্র ছেলে।সে বিয়ে করে বাইরে থাকে।আবির পিসিকে বলতেই পিসিও এক কথায় রাজি হয়ে যায়। ভাবিনি পিসি এতটা ভালো মানুষ হবেন।পিসির যেহেতু মেয়ে নেই ওই পিসি বলেন,
--আমার নিজের মেয়ে নেই।আমিও আজ থেকে একটা মেয়ে পেলাম।
তারপর পিসির বাড়ি থেকেই ডিভোর্স ফাইল করি। আমাকে সব দিক থেকেই পিসিই সহযোগিতা করেন। অবশেষে ডিভোর্স হয়ে যায়।চাকরির জন্য পড়াশোনা তো করছিলামই।।শেষমেষ আমিও চাকরি পাই।
পিসি এখন আমার মায়ের থেকেও বেশি। আমি কখন যে পিসির নিজের মেয়ে হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।আমার ভালো মন্দ সব পিসির হাতে ছেড়ে দিয়েছি।পিসি যখন আমাকে বিয়ের কথা বলেছিল আমি পিসিকে বলেছিলাম,
---ওটা তোমার দায়িত্ব। তুমি যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করবে।
বছর দুয়েক আগে একজনের সাথে পরিচয় হয়।ছেলেটি পিসির শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়।ওর নাম সৌজন্য।আমাকে দেখে ওর ভালো লেগে যায়।আমারও খারাপ লাগেনি ওকে।পিসিকে সে কথা আমি জানাই।পিসি বলে,
---সৌজন্য খুব ভালো ছেলে।বাংলায় এম.এ।চাকরি পায়নি।তবে বইয়ের দোকান করেছে। তোর পছন্দ থাকলে আমার অমত নেই।
তবে আবিরও বলেছিল সৌজন্য ভালো ছেলে।পরে আস্তে আস্তে জেনে ছিলাম সৌজন্য একজন ভালো মানুষ।জীবনে চলার পথে আমাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে সৌজন্য।সৌজন্য সরকারি চাকরি পায় নি। তাতে কী?একজন শিক্ষিত ভালো মানুষ হিসেবে সৌজন্য জীবন সঙ্গী হবার সব দিক থেকে উপযুক্ত।সরকারি চাকরি করা ছেলে মানেই সে যে ভালো মানুষ হবে এমনটা নয়। তবে কয়েকজন ভালো মানুষকে না পেলে আমার জীবনটা অন্ধকারেই হারিয়ে যেত।আজ ওরাই আমার জীবন পথে আলোর দিশারী।
-:সমাপ্ত:-
▪️দিশারী
▪️সরজিৎ ঘোষ ✍🏾
0 মন্তব্যসমূহ