Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

মায়া

#মায়া ✍️ #রেহানা_পুতুল 
তাদের দাম্পত্য জীবনের দুই যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে আরো তিন বছর আগেই। এতটা বছর স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনের মায়ায় জড়িয়ে ছিলো স্বর্ণলতিকার মতোই। 
কিন্তু ঠিক যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যুগুলোকে কেন্দ্র করে দীর্ঘবছরের গড়ানো সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তে আজ দুজনই অটুট। তাদের এই সিদ্ধান্তে তাদের ছেলে মেয়েরাও আনন্দিত।

বাঁধ সাধলো তাদের শ্বশুর শাশুড়ী। সমাজ কি ভাববে? সমাজ কি বলবে? মান ইজ্জত আর রইল না। মিলির শাশুড়ী ছেলের বউয়ের দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু গলায়,

"বউ তোমার কি ভিমরতি হয়েছে?এই বয়সে তোমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে? কচি বয়সে স্বামীর সংসারে রয়ে সয়ে ছিলে। আর এখন পারনা থাকতে? এটা মানা যায়?"

 মিলি শ্বাশুড়ির দিকে চেয়ে একগাল হেসে বলল, 

"আম্মা আমার পরিবেশ আপনি পেলে আপনিও চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেন। তখন আমার বয়স অল্প ছিলো। ছেলেমেয়েরা ছোট ছিলো। তাদের কথা ভেবে, সমাজ আর সম্মানের ভয়ে মানিয়ে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি। বোধের অভাব ছিলো। সাহসের ঘাটতি ছিলো। যুক্তি দাঁড় করানোর মতো জ্ঞানবুদ্ধি ছিলো না। আজ পরিপূর্ণ আমি। বিপুল সাহস সঞ্চয় করেছি। বোধেও ঘাটতি নেই। যুক্তিও খন্ডন করতে শিখেছি। আমি একজনের শূন্যতায় এ সংসারে কিছুই থেমে থাকবেনা।"

মিলির শাশুড়ী দপদপ পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাতি নাতনির কাছে গেলো। মুখ গোঁজ করে বলল,
"তোরা মা বাবাকে বোঝাতে পারিসনা? পড়াশোনা করে কি শিখেছিস?"

মিলির বড় ছেলে দাদীকে শক্ত গলায় বলল,

" দিদা শোন, ছোট ছোট বিষয়গুলো স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনকে মধুর করে। মজবুত করে। গভীর করে। এই যেমন ধরো, দাদা বাইরে থেকে আসতে কোনদিন তোমার জন্য পছন্দের একটা সুতী শাড়ী কিনে আনলো। দাম কিন্তু খুব অল্প। কখনো আসতে কেক নিয়ে আসলো। কিছু ফল আনলো। চানাচুর, লজেন্স, পান নিয়ে আনলো। তখন তুমি অনেক খুশী হও দাদার উপর। এই ভালোলাগা,বিশ্বাস, আর খুশীর জোরেই একটা সম্পর্ক টিকে থাকে। দীর্ঘায়ু হয়।  
ঠিক তদরূপ ছোট ছোট অমিলগুলো, ভুল বোঝা, না মেনে নেওয়া থেকেই জন্ম নেয় বিপরীতজনের উপর ক্ষোভ,হতাশা,দুঃখ, বিরক্তি ও অসহিষ্ণুতা। যেমন, আম্মু ঘুমাচ্ছে। তখন আব্বু ইউটিউবে নিউজ দেখছে উইদাউট হেডফোন।

 আম্মু চোখে লাইটের অতিরিক্ত আলো নিতে পারে না। আব্বু অকারণেই দিনের আলোতেও রুমের সব লাইট জ্বালিয়ে রাখে দোকানের মতো।  
এসিতে আম্মুর সমস্যা। কাশি আসে। আব্বুকে অনুরোধ করেও অফ করানো যায়না এসি।
 খেতে বসলে আব্বু বলে তরকারিতে হলুদ বেশী,মসলা বেশী,ঝাল বেশী, লবন বেশী ইত্যাদি। এরা কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। আমাদেরও আর সহ্য হয়না। আরো ইন্টারনাল বিষয়ত রয়েছেই দু'জনের। সেসব আমরা জানিওনা। তার চেয়ে দুজন আলাদা থাকুক। সেটাই ভালো। আম্মু থাকবে নানুর দেওয়া ফ্লাটে। সমস্যা কি? আমরা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি। কারো উপর নির্ভরশীল নয়। 
 নিত্য খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে সংঘাতের চেয়ে সেপারেশনে চলে যাওয়া বেটার। সমাজ, সম্মান করে করে, কত নারীর চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস মিশে গিয়েছে রান্নাঘরের ধোঁয়ায় আর শিলপাটার মসলার সাথে। জানো?"

মিলির শাশুড়ী নাতির যুক্তি শুনে আহাম্মক বনে গেলো। বলল,
"এই তোর বিদ্যার্জন? খুব বড় বড় কথা শিখেছিস। এসব কোন কথা হলো?"

বলে তিনি হনহন পায়ে ছেলের কাছে গেলেন। গলায় তেজ ঢেলে বললেন,

"সমস্যা কি তোদের? জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। হুহ! আমিই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।"

মিলির স্বামী জাবেদ নিরুত্তর রইলো। মায়ের কথার কোন প্রতিউত্তর দিল না।

মিলি দুমাস ধরে আলাদা বাসায় থাকছে। আজ ডিভোর্স হয়ে যাবে জাবেদ ও মিলির। অর্থাৎ তালাকের নোটিশ দুজন দুজনের ঠিকানায় পাঠাবে ডাকযোগে। ইতঃমধ্যেই সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। 

কিন্তু অবশেষে তা কার্যকর হয়নি। শেষ বিকেলের আবছা আলোয় বাসার দুয়ারে কারো পা পড়তেই চমকে গেলো জাবেদ। চোয়াল শক্ত করে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে চাইলো মিলির দিকে। তার শাশুড়ী এগিয়ে এলো খুশীমনে।

 ছেলেমেয়ে এগিয়ে এসে,

"আম্মু এলে কেন? আব্বুকে ছেড়ে দিবেনা?"

"একদম নাহ?"

তারা চোখ বড়বড় করে,
"কারন?"

"কারণ, তোর বাবাকে ডিভোর্স দিলে এ সংসারের সবকিছুর উপর আমার আর কোন অধিকার থাকবে না। সংসারে আমার সঞ্চিত টাকা দিয়ে কেনা জিনিসগুলোর উপর যে মায়া জমে গিয়েছে। সেই মায়া বিচ্ছিন্ন করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্যকর। আমি আমার সেই মায়ার জন্য ফিরে এসেছি।"

তারা ছুটে গেলো বাবার কাছে। 
"আব্বু তুমি ছেড়ে দিবে না আম্মুকে?"

"নাহ।"

"কারণ?"

"তার হাতের সকাল সন্ধ্যা দু'কাপ চা না হলে আমি আবার কোন কাজে মন বসাতে পারি না। এটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে আমার। এই অভ্যেসটুকুকে ভুলে যেতে চাই না।"

মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বাঁকা হেসে বলল জাবেদ। 

ছেলেমেয়েরা খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেলো। তাদের দাদীও উচ্ছ্বসিত বউ ফিরে এসেছে দেখে। তিনি মিলিকে ধরে বললেন,

"দেখলে বৌমা। চাইলেই ছেড়ে যাওয়া যায়না সংসার ছেড়ে। মায়া জিনিসটা খুব ডেঞ্জারাস। মরন অবধি জোঁকের মতো কামড় মেরে বসে থাকে।"

মিলি মুচকি হেসে ফেললো। বলল,

" আম্মা একদম ঠিক বলছেন। কত শত ভেবেছি নিজের সাথে। যতবার ভেবেছি এই মানুষটার সাথে বাকিজনম কিভাবে কাটাবো। বয়স বাড়ছে আর কেমন একরোখা হয়ে যাচ্ছে। নিজের মর্জিতেই সব হতে হবে তার। ততবারই ওই এক 'মায়া' নামক শব্দটার কাছে পরাজিত হয়েছি যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের মতই।"

জাবেদ কাষ্ঠ হেসে ছেলেমেয়েকে শুনিয়ে মিলির উদ্দেশ্যে বলল,

" তোদের মা আলাদা ঘুমাতে পারে চাইলে। মানা নেই।"

পাশ থেকে শুনে মিলি ঠোঁট উল্টিয়ে ভেংচি কাটলো জাবেদের দিকে চেয়ে। জাবেদ প্রথম দেখার মুহূর্তের মতো শিহরিত চোখে মিলির দিকে চেয়ে রইলো নিষ্পলক।

তারপর কেটে গেলো আরো বহুদিন। এক নিশিতে জাবেদ মিলিকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে বলল,

"সত্যি করে বল তো,তুমি কি সেদিন ফিরে এলে বস্তুর মায়ায় নাকি ব্যক্তির মায়ায়?"

"মায়ায় এসেছি। এটাই একমাত্র সত্য। ব্যখ্যা করে বলতে পারব না।"

অভিমানীনি সুরে বলল মিলি।

মুখ ভিড়িয়ে মুচকি হেসে কৌতুক করে জাবেদ বলল,
তাহলে আবারো প্রমাণিত হলো,

"নারীর বুক ফাটে,কিন্তু মুখ ফোটে না।"

#মায়া #সমাপ্তি #গল্প

✍️ #রেহানা_পুতুল

#motivationdaily #inspiration #motivated #lifehacks #life
 #shortstory #lifestory #fb #shortstory #storytelling #bengalistorytelling

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ