আজ আমার মা কে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে। খবরটা শুনে আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না! পারব কী করে এ তো সুস্থ হওয়ায় ছাড়া নয় পরাজিত হয়ে ছাড়া!
ডাক্তার আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন, "রায়হান সাহেব কথাটা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে! আমরা অত্যন্ত দুঃখিত! চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত উন্নতি হওয়ার পরও আজ আমরা কিছুই করতে পারছি না।"
"যদি মাকে বিদেশে কোথাও নিয়ে যাই?"
"সে আপনি নিতে পারেন কিন্তু কিছু হবে না। শুধু শুধু বিদেশের মাটিতে দৌড়াদৌড়ি করবেন। কোনো আশা থাকলে আমি বলতাম!"
কথাটা বলতে বুকের মাঝে কেমন বেধে যাচ্ছিল। "কতদিন টিকবে মা?"
"দেখুন নিশ্চিত করে তো বলা যায় না। আমাদের ধারনা ত্রিশদিনের বেশি টিকবে না। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন।"
আমি কিছুই বললাম না। শুধু অসহায় হয়ে ডাক্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে হু হু করে কান্না পাচ্ছিল।
"আপনার অবস্থা আমি বুঝি রায়হান সাহেব। এক কাজ করুন মাকে নিয়ে যান যা খেতে চায় খাওয়ান, আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করান। শেষ সময়টা আনন্দে কাটুক।"
আমার কাঁধে আলত করে চাপ দিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।
আমি মায়ের কাছে এসে বললাম," মা চলো আমরা বাড়ি যাই।"
মা বললেন," আমি সুস্থ হয়ে গেছি নারে?"
আমি মায়ের দিকে তাকতে পারছি না। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, "হ্যা মা।"
"আমি তো বলেছিলাম আমার কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে একটু ব্যথা করে, দুইটা ব্যথার ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। তুই জোর করে এখানে ফেলে রাখলি। এরা কী সব যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘাটাঘাটি করল।"
আমি খুব কষ্টে মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছি। মনে হয় ঠিক মতো পারছি না। বারবার হাসি হারিয়ে যায়!
মায়ের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিল একজন নার্স। নার্স কে মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল," যাই রে মা ভালো থেকো। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসো কেমন। আমি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছি।"
নার্সটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিল।
মাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম। মা কে জিজ্ঞেস করলাম," আজই বাড়ি যাবে না কি ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখবা? তুমি তো ঢাকায় আসতেই চাওনা! আবার কবে আসবা ঠিক নেই।"
"হ্যাঁ, চল আজ বরং ঢাকা শহরটাই ঘুরে দেখি।"
" কোথায় যাবা মা? "
"তোর মনে আছে খোকন একবার তুই টিভিতে শিশু পার্ক দেখে, শিশু পার্কে যাওয়ার জন্য কী কান্নাকাটি করেছিলি! তোকে তো তখন নিতে পারিনি! চল আজ যাই।"
মা কে নিয়ে শিশুপার্কে এসেছি, রাইডগুলোতে বড়োদের চলা যায় না। অনুরোধ করে ট্রেনে চড়লাম। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসেছি। আমার শুধু কান্না পাচ্ছে! মায়ের সামনে কাঁদতে পারছি না।
আমার মার এমনই ভাগ্য যখন স্বামী সন্তান নিয়ে কাটানোর কথা, আমাদের দুই ভাই-বোন কে মায়ের কাছে ফেলে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মা আমাদের নিয়ে সংগ্রাম করলেন। ছেলে বড়ো হয়েছে এখন একটু আরাম আয়েশ করবে এমন রোগ মাকে আঁকড়ে ধরল যা এ দুনিয়ায় দুই পারসেন্ট মানুষের হয়!
মা কে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। বাড়ির সবাই মায়ের খবর জানে শুধু মা জানে না! মা কে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসল বড়ো আপু। বড়ো আপুর হাসিতে কোনো প্রান নেই! দেখেই বুঝা যায় কত কষ্ট করে কান্না চাপিয়ে রাখছে!
মা বড়ো আপু কে দেখে বলল, "কী রে লুনা তুই চলে
এসেছিস?"
"মা তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছ এমন খুশির দিনে আমি আসব না তাকি হয় বলো।" বড়ো আপু অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল!
"ভালোই করেছিস।"
বড়ো আপু মা কে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। গ্রামের এ বাড়িটা করতে চাচ্ছিলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল মা কে নিয়ে শহরেই থাকব। কিন্তু মা কিছুতেই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হলো না। কি আর করার? মা এখানেই রয়ে গেল। শহরে গেলেও দুইয়েকদিন থেকেই হাঁপিয়ে উঠত।
বড়ো মামা এলেন সন্ধ্যায় এক গাদা বাজার নিয়ে। মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন! মা বলছে, "কি রে অমন করে কাঁদছিস কেন? আমি তো এখন সুস্থ। "
মামা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, "খুশিতে কাঁদছি রে বুবু।"
"তুই এত সব বাজার এনেছিস ক্যান?"
"কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না বুবু। তোমার হাতে পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল তাই। "
মা রাতের বেলা বড়ো আপার সাথে পিঠা বানাতে শুরু করলেন। সেই পিঠা আর বানানো শেষ হলো না।কিছুক্ষণ পরে ব্যথায় কেমন করতে লাগলেন। মা ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
দিনগুলো মনে হয় ঘড়ার গতিতে দৌড়াচ্ছে! কেমন করে নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। একটা করে দিন যায় আর বুকের মধ্যে কেমন শুন্য শুন্য লাগে! কয়েকদিন পর মা আমায় ডেকে বললেন, "তুই অফিসে যাস না কেন?"
"মা আমার ছুটি।"
"কীসের ছুটি নিয়েছিস? "
"অনেকগুলো ছুটি জমে গেছে মা, এখন ছুটি না কাটালে আর কাটাতে পারব না! "
দিন যেতে লাগল রোগটা মা কে একটু একটু করে কাবু করতে লাগল! চোখের সমানে মাকে ক্ষয়ে যেতে দেখছি কিছুই করতে পারছি না! আমার মতো এত অসহায় সন্তান পৃথিবীতে নাই!
বড়ো আপা মাঝে মাঝে কেঁদে উঠে মায়ের সামনে গেলে জোর করে হাসার চেষ্টা করে! মা জিজ্ঞেস করলে বলে, "বাবার কথা মনে পড়ছে মা!"
বড়ো মামা একেকদিন একেকটা জিনিস নিয়ে এসে বলে,"আপা আজ তোমাকে নিয়ে এটা খেতে ইচ্ছে হলো।"
দিন যাচ্ছে আর মা কেমন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে! আমাদের আশা কেমন ফুরিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। আমার মন বলে হুট করে মা ভালো হয়ে যাবে। উঠে বলবে দ্যাখ আমি সুস্থই আছি তোর ও সব ডাক্তার -ফাক্তার সব ভুয়া।
মায়ের হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা উঠল। মায়ের সারা শরীর কেমন নীল হয়ে গেছে। মা সবাই কে কাছে ডাকলেন। বড়ো আপা আসছে মা সে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি পাশে বসে আছি। আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমার মা আর থাকবে না! এটাই বোধহয় মায়ের শেষ কথা! বড়ো মামা কেঁদে কেঁদে বলছে, "কী হয়েছে বুবু?"
মায়ের কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে! জোর করে শ্বাস নিচ্ছে! খুব কষ্ট করে মা আমার মাথায় হাত রেখে বলল, "আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার কী যে ভালো লাগছে! আমার আপন মানুষগুলো আমায় এত ভালোবাসে! আমাকে মরতে দিতে চায় না। বাবারে মানুষ তো চিরদিন বাঁচে না!"
মা আর কথা বলতে পারল না। কেমন ছটফট করতে লাগল! চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। একটা সময় আমার মা ঘুমিয়ে পড়ল! সেই ঘুম আর ভাঙ্গল না!
অফিস থেকে ত্রিশদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। পনেরো দিনের ছুটি রয়েই গেল! আমার মা এমনই সবার থেকে আলাদা !
মা
nabil mahmud
0 মন্তব্যসমূহ