সেটা ষাটের দশকের কথা, দুবছর আগেই শেষ হয়েছে চীন ভারত যু/দ্ধ। বাবা বদলি হয়ে এল ব্যারাকপুরে HAL এর নতুন কারখানায় আর তার কয়েকমাস পরে আমরাও। তখন থেকে পথচলার সঙ্গী হলো বাস। স্কুল কলেজে গেছি বাসে, এমনকি বাংলায় এসে কোয়ার্টারে জায়গা পাওয়ার আগে অব্দি চাকরিতেও গেছি বাসে। মাঝে অবশ্য বি/য়েটা করেছি অ্যাম্বাসেডর চেপে। তবে শেষ যাত্রায় বাসে চেপে যাবার সুযোগ দেখছি না। তার আগেই যে বেজে গেছে বাসরুট গুলোর মৃ/ত্যুঘণ্টা !
একসময ছিল বেসরকারি বাসের রমরমা। দু দরজা ওয়ালা পাবলিক বাসে ড্রাইভার ছাড়াও থাকতো দুজন কন্ডাকটর ও গেটে দুজন সহিস। ড্রাইভারের হাতে স্টিয়ারিং থাকলেও সে যেন ‘রক্তকরবী’র সেই প্রাসাদ বন্দী রাজার মতো। মানে বাসের সামনের গ্রিল-ঘেরা জায়গাটুকুর মধ্যেই তার ডেরা। কেউ তাকে পরিষ্কার দেখতেও পায়না । ফলে বাসকেন্দ্রীক যা কিছু তা সব এই কন্ডাক্টরদের ঘিরেই।
সস্তার পরিবহন বলতে তখন শুধু এই বাস তাই ভীড় হতো খুব। আর যতই ভীড় থাকুক বাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের কন্ডাকটর বাবাজী ক্রমাগত বলে চলতো 'ভেতরে ঢুকুন ভেতরে ঢুকুন' আর যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে বলত, ‘আর কোথায় ঢুকবো বাপু? ভেতরে কেমন গড়েরমাঠ রয়েছে একবার নিজে ঢুকেই বরং দেখে এসো না !’ তারা অবশ্য ঐ ভীড়টিড় ঠেলে দিব্যি টিকিট কাটতো। বেয়াড়া যাত্রীদের কাছে গিয়ে বলতো, ‘টিকিটটা এবার কেটে ফেলুন কাকা, আর দিচ্ছি-দিচ্ছি করবেন না!’ টিকিট না কেটে উপায় ছিলোনা। এমনকি বাস থেকে নামবার সময় কনডাক্টরকে খ/পাৎ করে ধ/রতেও দেখেছি। অল্প পয়সা হাতে ধরিয়ে দিয়ে, ‘আরে রাখো না, টিকিট লাগবে না …’ বলে কিছু যাত্রী পয়সা বাঁচাবার চেষ্টা করতো বরাবর। আবার কেউ টিকিট না-কেটে নেমে পড়লে সে-ও তার সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে, বাসের গায়ে চাপড় মেরে বাসটাকে থামিয়ে দিয়ে, তার টিকিট কাটত। মাঝ রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেলে, যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে দিত এই কনডাক্টররাই। দেশের অন্য রাজ্যে কিন্তু এখানকার কন্ডাকটরদের মতো এমন যাত্রী-সহায়কের ভূমিকায় দেখিনি।
উঠতি ছেলেছোকরাদের ফুটবোর্ডে ঝুলতে বারণ করতো তারা। এমনকি বাসে পকে/টমা/র উঠলে যাত্রীদের ইশারায় সতর্ক করে দিত। রাত্তিরে কোনও মো/দো মা/তা/ল আচমকা বাসে উঠে পড়লে, ওরাই বাস থামিয়ে তাদের ঘাড় ধরে নামিয়ে দিত। চলতি বাসে আচমকা রড ধরে ঝুলে পড়া মাঝবয়সি কোনো মহিলাকে নড়া ধরে বাসের ভেতরে তুলে নিতো। তারপর তাঁকে ‘মাসিমা’ না-বলে ‘দিদিমা’ বলে ফেলায়, ‘কেন রে পো/ড়া/রমু/খো, চোখের মাথা কি খেয়েছিস নাকি রে!’– গোছের ভর্ৎসনাও দিব্যি হজম করতো ।বা/চ্চা-কোলে কোনো মা বাসে উঠলে তাকে ইশারায় বলে দিতে, কোন জায়গার সিট তাড়াতাড়ি খালি হবে। তারা বা/চ্চা নিয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার সময় কনডাক্টরের মুখেই শুনতে পাওয়া যেত সেই ইতিহাস হয়ে যাওয়া ডায়লগটি, ‘আস্তে লেডিস, কোলে বা/চ্চা!’ এসব ছবি তো কোনোদিনই মুছে যাওয়ার নয়
লেখা : স্বপন সেন
0 মন্তব্যসমূহ