‘আপনাকে তুলতে হবে না। আপনি বরং রান্না শুরু করুন। খিদেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।’
‘এই লুঙ্গিটা পরুন। ধোয়া আছে। আজ সকালেই সোডা দিয়ে ধুয়েছি। আমার আবার পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে, নোংরা সহ্য করতে পারি না।’
ভদ্রলোক যে নোংরা সহ্য করতে পারেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তিনি রান্না করতে বসেছেন উঠোনে। উঠোনেই পরিষ্কার ঝকঝকে দুটো মাটির চুলা। সুধাকান্তবাবু চুলার সামনে জলচৌকিতে বসেছেন। থালা, বাটি, হাঁড়ি সবই দেখি দু’ বার তিন বার করে ধুচ্ছেন।
‘সুধাকান্তবাবু?’
‘বলুন।’
‘আপনি বিয়ে করেন নি?’
‘না।’
‘চিরকুমার?’
‘ঐ আর কি।’
‘আপনি করেন কী?’
‘শিক্ষকতা করি। হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মনোহরদি হাই স্কুল।’
‘রান্নাবান্না আপনি নিজেই করেন?’
‘হ্যাঁ, নিজেই করি। এক বেলা রান্না করি। এক বেলা ভাত খাই, আর সকালে চিঁড়া, ফলমূল—এ-সব খাই।’
‘কাজের লোক রাখেন না কেন?’
‘দরকার পড়ে না।’
‘খালি বাড়ি পড়ে থাকে, চুরি হয় না?’
‘না। চোর নেবে কী? আমি এক জন দরিদ্র মানুষ। আপনি স্নান করে নিন। স্নান করলে ভালো লাগবে।’
অপরিচিত জায়গায় ঠাণ্ডার মধ্যে গায়ে পানি ঢালার আমার কোনোই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সুধাকান্তবাবু মনে হচ্ছে আমাকে না ভিজিয়ে ছাড়বেন না। লোকটি সম্ভবত শুচিবাইগ্রস্ত।
কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে-মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা ধরা প্রাচীন কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতো চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য।
‘সুধাকান্তবাবু?’
‘বলুন।’
‘রান্নার কত দূর?’
‘দেরি হবে না।’
‘একা-একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?’
‘না, অভ্যেস হয়ে গেছে।’
‘বাসায় ফিরে আপনি করেন কী?’
‘তেমন কিছু করি না। চুপচাপ বসে থাকি।’
‘ভয় লাগে না?’
সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।
খাবার আয়োজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নি। একটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধ—খেতে একটু টক-টক। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়া। ডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নি। এমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে তা-ই আমার জানা ছিল না। মুগের ডাল। ডালে ঘি দেওয়াতে অপূর্ব গন্ধ।
আমি বললাম, ‘সুধাকান্তবাবু, এত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে।’
সুধাকান্তবাবু বললেন, ‘আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালো লেগেছে। রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই।’
আমি চমৎকৃত হলাম।
লোকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা। -বৃহন্নলা
0 মন্তব্যসমূহ