Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ভোরের আগে।

ইচ্ছে ছিল একটি ভালো মনের ছেলে বিয়ে করার। অনেক বেছে দেখে শুনে শেষ পর্যন্ত জুটলো এক হাবলা। হদ্য বোকা। 
  বাড়িতে কথা বলার সময় সরলমতি দেখে ভেবেছিলাম ফ্রেশ মাইন্ডেড। ইনোসেন্ট। এখন দেখি উল্টো।
    বাসর রাতে উদ্ভট সেজেগুজে কোত্থেকে একটা ছুরি হাতে এসে হঠাৎ সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করল, প্রথম রাতেই নাকি বিড়াল মারতে হয়? কোথায় বেড়াল?
   সুন্দর একটা ছেলে। মাঘের শীতে হঠাৎ খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে বাসর ঘরে লাফ দিয়ে এসে কেউ যদি এমন আচরণ করে, ভয় কে না পায়! আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম আমাকেই খুন করবে। বাপরে বাপ! 
   এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। পরের টুকু আরও উদ্ভট। 
ঘরে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে বিড়ালের হদিশ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে চিৎকার করে বলল, যতক্ষণ বিড়াল না মারতে পারছি ততক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকছি না। যেখান থেকে পারো কালকে বিড়াল আনবে। মনে থাকে যেন। হুঁশিয়ার। বলেই লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই যে গেল আর এলোনা।
   প্রথমে ভেবেছিলাম বোকা। এখন দেখছি উন্মাদ। প্রথম শ্রেণীর পাগল। হায় কপাল! শেষ পর্যন্ত এক পাগলকে বিয়ে করেছি! 
   কিন্তু কি আশ্চর্য! বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্তত তিন মাস আগে। মাঝে অনেকবার কথা বলেছি। একসঙ্গে মার্কেটিং করতে গেছি। অন্তত দুবার খেতে গেছি। কখনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি। এলোমেলো কথা বলেনি। পাগলের বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছিল না। হঠাৎ এমন কি হলো! তবে কি বিয়ের আনন্দে বিগড়ে গেলো! নাকি বংশে এমন ধাত আছে! 
   বুঝিয়ে দুটো কথা বলব সেই সুযোগ পেলাম না। হুংকার দিয়ে বাবু বেরিয়ে গেলেন। বিকেল পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল! কত মজার মজার কথা বলল। অন্তত তিনবার এসে ফাজলামি করে গেল। হানিমুনে উটি যাব তার টিকিট পর্যন্ত দেখিয়ে গেল! তবে কি নেশা করে এসেছিল? মাতাল নয় তো!
   এবার আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। যদি মাতাল হয়! নেশা করে যদি এসে মারে! শুনেছি মাতালদের মাথা ঠিক থাকে না। রাতেই বিগড়ায় বেশি। নিশ্চিত সুরঞ্জন কিছু একটা খেয়েছে!
   মাথায় উঠলো বাসর রাত। ধুয়ে গেল সমস্ত স্বপ্ন। এমন দিনে এমন কাণ্ড ঘটতে পারে কল্পনারও অতীত। 
  ভাবলাম মাকে একটা ফোন করি। সমস্ত বলি। বাবাকেও জানাই। 
  কিন্তু কি বলবো! ছেলে পাগল! উন্মাদ! মাতাল! হঠাৎ এ কথা শুনে মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়। বাবা যদি কিছু করে ফেলে। মেয়ের বিয়ে তাদের কাছে একটা স্বপ্ন ছিল। অনেক খুঁজে অনেক বেছে তবে এই পাত্র নির্বাচন করেছিলেন তাঁরা। 
   ভেবে দেখলাম এখনই বলার সময় নয়। আগে সকাল হোক। সুরঞ্জনের সঙ্গে একান্তে কথা বলি। যদি বিন্দুমাত্র উন্মাদের লক্ষণ বুঝি তখন না হয় জানানো যাবে। এখন আপাতত ঘরে দরজা দিয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো।
     ঘন্টাখানেক কেঁদে কেটে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ জানালায় ঠুকঠাক। কান খাঁড়া করে ভয়ে ভয়ে উঠে বসলাম। জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম। 
   কাছে যেতেই শুনলাম চাপা গলায় সুরঞ্জন বলছে, বিড়াল পেয়েছো! পেলে বলবে। আমি এখানেই রইলাম।
  কি সর্বনাশ! পাগলটা ধারে কাছেই আছে! এবার ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। যদি দরজা ভেঙে ঢোকে! বিড়াল না পেয়ে যদি কিছু একটা করে বসে। মারে! 
  ভাবলাম চিৎকার করে শ্বশুর শাশুড়িকে ডাকি। বাড়ি ভরা আত্মীয়-স্বজন তাদের ডাকি। 
  পরক্ষণেই ভাবলাম না থাক। আগে সকাল হোক।

সকাল হবার আর দরকার হলো না। তার অনেক আগেই সুরঞ্জন এসে দরজায় ঠক্ ঠক্ করতে লাগলো।
 খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিয়ের দিন একেবারে ঘুম হয়নি। পরের দিন আরো না। আর আজ যা চলছে..
  ভেতরে ভেতরে খুব রাগ হয়েছিল। এমন মাথা খারাপ ছেলে সময়মতো চিনতে পারিনি বলে নিজের ওপরেও রাগ হচ্ছিল। বাবা-মায়ের উপর রাগ হচ্ছিল। যারা ছেলে দেখতে প্রথম এসেছিল তাদের ওপরও রাগ হচ্ছিল।
  এখন সুরঞ্জনের ডাক শুনে বিরক্ত লাগছে। ঘরে ঢুকে আবার হয়তো বিড়াল খুঁজবে। নয়তো ইঁদুর খুজবে। নয়তো আরো কিছু। নতুন ফন্দিও আঁটতে পারে। হাফ ম্যাড ছেলে কখন কি করবে বোঝা মুশকিল।
  সুরঞ্জন এতক্ষণ দরজার ঠক্ ঠক্ করছিল। এবার নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। চাপা গলায় বারবার ডাকছে। 
  এরপর দরজা না খুললে বেয়াদবি হবে। ঘুমন্ত বাড়িঘর আবার নতুন করে জেগে উঠবে। নানা জন নানান রঙের প্রশ্ন ছুড়বে। রঙ্গ তামাশা দেখতে শেষ রাতে ভিড় জমে যেতে পারে।
   ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই আচমকা হুড়মুড়িয়ে তিন-চারটে ছেলে ঢুকলো। একদম শেষে সুরঞ্জন। হাতে কিসের যেন একটা ইয়া বড় প্যাকেট। 
 ছেলেগুলো দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। ডাকাত নয়তো এরা!
   মুহুর্তের মধ্যে ছোকরাগুলো ঘরের সমস্ত লাইট জেলে দিয়েছে। টেবিল টেনে ঘরের মাঝখানে এনেছে। তারপর সুরঞ্জনের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে খুলে একটা বড় সাইজের কেক টেবিলে রেখেছে।
    একটা ছেলে আমার হাতে দেশলাই দিয়ে বলল, বৌদি মোমবাতিটা ধরান। হিসেব মত আজ আপনার জন্মদিন। সবই দাদার প্ল্যান। বলেই ছেলেগুলো মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। যেন জাদুকর তাদের ফুঁ দিয়ে অদৃশ্য করে দিল।
   অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম জড়ানো চোখে আমাকে কেক কাটতে হল। কেক খেতে হল, খাওয়াতে হল। বিয়ের তালবাহনায় ভুলেই গেছিলাম সত্যি সত্যি আজ আমার জন্মদিন। সুরঞ্জন মনে রেখেছে দেখে হঠাৎ একটা ভালো লাগার আবেশ ঘিরে ধরলো আমায়। কিন্তু ভয় ভয়ও করতে লাগলো। সন্দেহ হতে লাগলো সুরঞ্জনকে দেখে। তাহলে কি ও পাগল নয়! 
  সুরঞ্জন অনেকক্ষণ আমায় দেখল। কি যেন ভাবল, তারপর হঠাৎই মোমবাতিটা আমার হাতে দিয়ে মুখটা ভার করে বলল, তোমার কি মনে আছে আজ আর একজনার মৃত্যুদিন!
  হঠাৎ চমকে উঠলাম। মৃত্যুদিন! কার মৃত্যুদিন! আমাদের বাড়িতে এই ডেটে কেউ মরেছে বলে মনে করতে পারলাম না। সুরঞ্জনদের বাড়িতে এই দিন কেউ মারা গিয়েছিলেন কিনা জানিনা। ফলে হা করে তাকিয়ে থাকতে হলো সুরঞ্জনের চোখের দিকে।
   সুরঞ্জন এবার হাসলো। হাসিতে কেমন যেন বেদনা মেশানো। হাসি থামলে সুরঞ্জন বলল, আজ মুকুলের মৃত্যু দিন। আমায় বলেছিলে মনে করে দেখো। দৌড়ে ট্রেন ধরতে গিয়ে, চোদ্দ নম্বর রেলগেট।
   আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যিই আমি ওকে মুকুলের কথা বলেছিলাম। ভালবাসতাম তাও বলেছিলাম। ওর মৃত্যু আমার কাছে এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। আমার প্রথম ভালবাসার মৃত্যু। 
 আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে সুরঞ্জন ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আমার কাছে। একটা হাত ধরে বলল, ভালবাসার মৃত্যু হয় না মৈথিলী, রূপান্তর হয়। ভোর হয়ে আসছে। চলো বাইরে যাই। ওর আত্মার শান্তি কামনা করি। আজ তোমার ভালবাসার সঙ্গে মিশে যাক আমার শ্রদ্ধা। এইটুকু ওর প্রাপ্য।
  আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম সুরঞ্জনের বুকে। ঝর ঝর করে চোখ ফেটে জল পড়তে লাগলো টপটপ করে। আমার ভালবাসাকে অপমান না করে এইভাবে শ্রদ্ধা জানাবে সুরঞ্জন কল্পনায়ও ভাবিনি। অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকার পর হঠাৎ মনে হল এই তো আমার মুকুল! আমার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার নতুন মুকুল।।

ভোরের আগে। 
#বাবুরাম_মন্ডল।
    🖊️ বাবুরাম মন্ডল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ