Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

মকরের পরবে

পাড়ার চায়ের দোকানে বসে ভানু একদিন বলে ফেলেছিল, আমার বউ যখন চান করে কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ পরে, ভিজে চুলে তখন ওকে ঠিক মা লক্ষ্মীর মত দেখায়। সেই কথা চায়ের দোকান থেকে বটতলা, জামতলা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়। হাসির ঢল নামে, আর ভানুকে দেখলেই ব্যঙ্গ ছোঁড়ে, কী রে ভানু, তোর বউ যে লক্ষ্মী, তবে তোর এত অভাব কেন রে বাপ? 
ভানু খুব গরীব। এদিক ওদিক টুকটাক কাজ করে। ছেলেবেলায় এক কঠিন অসুখের পরে সে খুব ভারী কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই তার ও তার লক্ষ্মীর সংসারে অভাব নিত্য সঙ্গী। কিন্তু ভালোবাসা একটুও কম নেই। কেউ তাদের ঠাট্টা করলেও বা কী! অভাব থাকলেই বা কী! সে রোজ বাড়ি ফিরে এসে আগে তার বউকে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যিই তুই আমার লক্ষ্মী বউ! 

পৌষ মাসের শেষ হতে চলেছে। ভানুর লক্ষ্মী পিঠে খেতে খুব পছন্দ করে। ভানু তা জানে। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় সে একেবারেই বেশি কাজ করতে পারে না। শরীর বয় না। তবুও চেষ্টা করে। মকর পরবের মেলায় সে তার বউকে লাল চুড়ি কিনে দেবে। তার বউ সেই চুড়ি পরে পিঠে বানাবে। রিনরিন করে শব্দ হবে। কী মিষ্টি যে লাগবে সেই শব্দ! ভানু ভাবে। 

অনেক চেষ্টায় দু একজনের বাড়ির কিছু কাজ করে ভানু চাল গুঁড়ি, আর একটু গুড় কিনে নিয়ে আসছিল… 

বড় রাস্তার উপর দিয়ে গাড়িগুলো যখন যায়, তাদের ভাবখানা এমন যে, থাকবে না অভাব! থাকবে না গরীব! দাও দাও ওদের শেষ করে দাও! 
ভানুর শরীর শুয়ে পড়ে রাস্তার উপর। তাকে চাপা দেওয়ার পর গাড়িটা একরাশ সাফল্য আর রক্তাক্ত চাকা নিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়। 

ভানুকে হাসপাতালে নিয়ে আসে ভানুর মতই দু একজন অভাবী মানুষ। তার বউকে খবর দেওয়া হয়। ভানুর হাত থেকে চাল গুঁড়ি আর গুড় নিয়ে হাসপাতালের একজন তার বউয়ের হাতে তুলে দেয়, এই নাও। এগুলো তোমার বরের হাতে ছিল। ভানুর বউ জিজ্ঞেস করে, ও কেমন আছে?
হাসপাতালের লোকটা কপাল কুঁচকে বলে, বাঁচবেনি মনে হয়…

ভানু সাত দিন হাসপাতালে। ভানুর বউ হাসপাতালের বাইরে। পৌষের ঠাণ্ডা, হিম হওয়ায়, কুয়াশা আর চাল গুঁড়ি গুড় নিয়ে বসে থাকে ভানুর বউ। কেউ হ্যাট হুট করে, কেউ দরদ দেখায়, তুই কতদিন এভাবে বসে থাকবি রে? বাড়ি যা। 
ভানুর বউয়ের কপালে সিঁদুরের টিপ আবছা হয়। সাতদিন পরে ভানু মরে যায়। 

ভানুর মৃত্যুর খবর তার বউয়ের কাছে দিতে এসে হাসপাতালের লোকটা দেখে রোগা হাড় জিরজিরে বউটা যে এই সাতদিন একভাবে এক জায়গায় বসে ছিল, কাঁদেনি, কথা বলেনি, খায়নি। সেই বউয়ের শরীর আছে, কিন্তু প্রাণ নেই। 
হাসপাতালে হৈ হৈ পড়ে গেল। মিডিয়া এল, রিপোর্টার এল। টনক নড়লো মন্ত্রীর… মাইক্রোফোন হাতে টিভিতে টিভিতে ঝড় উঠলো, কেন গরীব বলে কি ওরা মানুষ নয়? কেন ভানু ঠিকমত চিকিৎসা পেল না? কেন ওর বউ সাতদিন খেল না? কেউ কেন ওকে দেখলো না? ওর এমন মৃত্যু কেন হল? জবাব চাই! 

কবি লিখলেন, আহা এমন প্রেম! 

ভানুর বউয়ের হাতে শক্ত করে ধরা চাল গুঁড়ি আর গুড়। আজ বাদে কাল পরব। জীবনে না হোক, মৃত্যুর পরেই নাহয় ও ওর বর কে পিঠে করে খাওয়াবে। আর তার বর সোহাগ আর আদর তার মুখে তুলে দিয়ে বলবে, নে খা! ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলবে, লাল চুড়ি ছাড়াই তুই কী সুন্দর রে বউ! তুইই আমার লক্ষ্মী! মকর পরবে ওরা খুব আনন্দ করবে! 

ভানু আর তার লক্ষ্মী অপেক্ষা করছে ক্যামেরা আর মিডিয়ার কচকচানি বন্ধ হলে ওরা একসঙ্গে আগুন নেবে গায়ে। এই শীতে জড়াজড়ি করে আগুন মাখার আনন্দ ভেবে ওদের দুজনেরই মুখে কেমন আলো দেখো একবার!

মকর পরবে
সুজান মিঠি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ